রাস্তার কুকুর/Street Dog


চোখের সামনে কাউকে অসুস্থ দেখলে দেরি কোরো না

রাস্তার কুকুর
নাম: অপর্ণা দাস  

তারিখ: ১৮..২০১৮
কলেজ থেকে ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে সবে খবরের কাগজটা পড়বো বলে মুখের সামনে ধরেছি এমন সময় বাড়ির পিছনের রাস্তায় স্বজোরে একটা ঢিল পড়ার আওয়াজ কানে এলো আর ঠিক এর পর পরই শুনতে পেলাম এক মহিলা কণ্ঠস্বর, চিৎকার করে কাওকে কিছু বলছেন থাকতে না পেরে বাড়ির মেইন গেটের সামনে গেলাম. গিয়ে দেখলাম যিনি চিৎকার করছেন তিনি সম্পর্কে আমার এক আত্মীয় হন
জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে, আর একটু আগে ঢিলটা কি আপনিই ছুড়লেন? উত্তরে আমার ওই আত্মীয়া রাগে গড়গড় করতে করতে বললেন, দেখ না ওই পাজি বদমাশ কুকুরটার জ্বালায় আমার ছেলে-মেয়েগুলো রাস্তা পাড়াপাড় হতে পারছে না আমি একটু অবাক হয়েই বললাম, কোন কুকুরটা? উত্তরে ভদ্র মহিলা হাত উঁচিয়ে বললেন, ওই তো তোদের ঘরের পিছনের দিকটায় একটু ভালো করে দ্যাখ দেখতে পাবি
আমি হন্তদন্ত হয়ে গিয়ে দেখলাম একটি রোগা পাতলা, গায়ের রং সাদাকালো ডোরাকাটা কুকুর ভয়ে সিটিয়ে রয়েছে ঘরের পিছনের পাচিলের একদম কোনটায় কুকুরটাকে ওরকম ভয়ার্ত অবস্থায় দেখে বেশ মায়া হলো, তারপর ওই মহিলাকে বললাম, তো রাস্তা থেকে প্রায় ২৫ মিটার দূরে এক কোনে চুপটি করে বসে রয়েছে তাও তোমাদের রাস্তা পেরোতে সমস্যা হচ্ছে? উত্তরে ওই মহিলা তখন বললেন, না তুই জানিস না, একদিন আমার মেয়েকে তাড়া করেছিল যদি কামড়ে দিতো তাহলে কি হতো বল তো? এর মধ্যে কুকুরটা আমার কাছে দৌড়তে দৌড়তে চলে এলো,এই দেখে ভদ্র মহিলা আবার কুকুরটিকে মারবে বলে ঢিল তুলেছে অমনি আমি ওর হাতের ঢিলটা কেড়ে নিয়ে মাটিতে ছুড়ে ফেললাম. আর বললাম, বাড়িতে কোনো কাজ নেই তোমার বুঝি, নাকি টিভিতে এখনো সিরিয়াল শুরু হয়নি
যাইহোক মিনিট পাঁচেকের বাগ বিতন্ডার পর আমি কুকুরটিকে নিয়ে যেই না বাড়িতে ঢুকেছি বাবা-মা বাড়ির প্রত্যেকে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিলোমা তো কুকুরটিকে দেখেই একটি লাঠি নিয়ে মেরে মেরে ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিলোবাবা বললো, যতসব একটা রাস্তার কুকুরকে বাড়িতে এনেছে কিন্তু কি জানে অদৃষ্ট কখন কি ঠিক করে রাখেন কুকুরটিও নাছোড় গেটের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে হঠাৎ খেয়াল হলো, ওর খিদে লাগতেও তো পারে, সেই জন্যই হয়তো… কৌটো থেকে দুটো বিস্কুট নিয়ে যেই না গেটের সামনে গেছি অমনি কেমন ছোট্ট একটি বাচ্চার মতো মুখে আওয়াজ করতে করতে বিস্কুটগুলো খেয়ে ফেললো তারপর আমি ওকে আরও কয়েকটি বিস্কুট দিলাম এরপর দেখলাম বাড়ির পিছনের সরু গলিটার এক কোণে গিয়ে শুয়ে পড়লো
 সেদিন রাতে হঠাৎ বাজ পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো জেগে উঠেই প্রথমেই মনে হলো ওই কুকুরটার কথা এত বৃষ্টিতে এতক্ষন নিশ্চই ভিজে গেছে, বৃষ্টিতে ভিজে যদি ওর জ্বর আসে দূর কি সব ভাবছি তো রাস্তার কুকুর ওর আবার শরীর খারাপঘুমোনোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলাম খালি মনে হচ্ছিল আমি তো ২৪ ঘন্টা আগেও কুকুরটিকে কখনো দেখিনি তাহলে ওর জন্য কেন এত আনসান ভাবছি. পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই ঘরের পিছনে গিয়ে দেখলাম, কুকুরটি সেখানেই চুপটি করে শুয়ে রয়েছে
এরপর লেজটা নাড়তে নাড়তে আমার সামনে এসে আমার হাতের দিকে ফ্যালফ্যাল করে দেখতে লাগল বুঝতে অসুবিধা হলো না ওর খিদে পেয়েছে সবে বাড়িতে ওকে এনেছি কিছু খেতে দেবো বলে, অমনি মা লাঠি নিয়ে আবার ওকে তাড়া করলোমাটির একটি পাত্রে দুটো সন্দেশ নিয়ে বাড়ির বাইরে ওকে সবে খেতে দেবো হঠাৎ পাশের বাড়ির এক কাকিমা বললেন, তোমার কি মাথাটা গেছে, রাস্তার একটা কুকুরকে এত মাথায় তুলছো, যদি কাউকে কামড়ায় দেখবে তোমাকেই চিকিৎসার পুরো খরচ দিতে হবে কুকুরটিকে খেতে দিয়ে স্নান, খাওয়া সেরে সবে গেট খুলে রাস্তায় বেড়িয়েছি কলেজে যাব বলে হঠাৎ দেখলাম, কুকুরটি আমার পিছন পিছন আসছে টানা মিনিটের হাঁটা পথ আমার সঙ্গে এলো এবং ততক্ষন দাঁড়িয়ে রইলো যতক্ষণ না আমি অটোয় উঠলাম
বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার মুখে বাড়ির পিছনের গলিতে চোখ বুলালাম, দেখলাম ওই কোনে শুয়ে রয়েছে যেই না আমি ওকে ওই বলে ডাকলাম সঙ্গে সঙ্গে রকেটের গতিতে আমার কাছে চলে এলো  ভাগ্যক্রমে বাড়িতে তখন কেউ ছিল না আমি ওকে উঠোনে একটি পাত্রে জল আরেকটি পাত্রে খাবার খেতে দিলাম দেখলাম জলটা খেয়ে চুপচাপ উঠোনের মাঝখানে শুয়ে পড়লো আমি খাবারের পাত্রটা ওর মুখের সামনে নিয়ে গিয়ে বললাম, খাবারটা খেয়ে নে খেলো না, মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, কি হয়েছে খাচ্ছিস না কেন? কিছু একটা বলার চেষ্টা করেও বলতে পারলো না এক দৃষ্টিতে আমার মুখপানে চেয়ে রয়েছে. বুঝতে অসুবিধা হলো না ওর শরীর খারাপ হয়েছে
সেদিন রাতে আমি আর কোনো ঝুঁকি নিলাম না. বাবা-মায়ের সাথে রীতিমত ঝগড়া করেই ওকে বাবার গাড়ি রাখার ঘরে শোবার ব্যবস্থা করে দিলাম সঙ্গে একটি পাত্রে খাবার ডালিম. সকালে ঘুম থেকে উঠে দখলাম বাবা গেট খুলে গাড়ি বের করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাড়ির গেটের সামনে চলে এলো ওকে দেখে কৌটো থেকে একটি বিস্কুট বের করে খেতে দিলামআবার মুখ ফিরিয়ে নিল, খেলো না কলেজে যাবার আগে গাড়ির ঘরের দরজাটা দিয়ে গেলাম যাতে ওর এই অসুস্থ শরীরে কেউ মার্ না দেয় কলেজে সারাক্ষণই ওর অসুস্থ শরীর আর নিষ্পাপ চোখ দুটো মনে পড়ছিলো
সেদিন বাড়ি ফিরেই গাড়ির ঘরে গিয়ে দেখলাম চুপচাপ শুয়ে রয়েছে আমায় দেখে শুধু লেজটা নাড়লো দেখলাম খাবারের পাত্রতে সকালে যেভাবে রেখে গেছিলাম সেভাবেই পরে রয়েছে মনে মনে হিসেব কষলাম, এই নিয়ে তিনদিন কিছু খাচ্ছে না ওর সত্যি মারাত্মক কিছু একটা হয়েছে ওকে এখুনি ডাক্তার দেখাতে হবে গুগল থেকে নেয়ারবাই বেশ কতকগুলো ভেটেরিনারি (পশু, পাখিদের চিকিৎসা কেন্দ্র) হাসপাতালের নম্বর জোগাড় করে ফোন করতে শুরু করলাম যেখানেই ফোন করলাম সেখান থেকে উত্তর এলো, এখন সন্ধ্যা ৭টা বেজে গিয়েছে কাল সকাল ১০টার পর আনুন ভর্তি করে নেবো কিন্তু সকাল হতে তো এখন অনেক বাকি তার যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়এর মধ্যে টর্চ নিয়ে গাড়ির ঘরে গিয়ে দেখলাম বারবার ওঠার চেষ্টা করেও উঠে দাঁড়াতে পারছিল না
তিনদিন জল ছাড়া মুখে একটা দানাও যে কাটেনি এর মধ্যে কোনোক্রমে গেটের বাইরে বেরিয়ে ঘরের সামনের কিছু ঘাস জাতীয় আগাছায় মুখ ঠেকিয়ে সুখে সুখে ঘাস ছিঁড়ে খেতে শুরু করলো একি কি খাচ্ছে? তিনদিন যে মুখে একটা ডানা কাটেনি সে কিনা এই অসুস্থ শীর্ণকায় শরীরে ঘাস খাচ্ছেএকটু অবাক হয়েই পরিচিত এক জেঠুকে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ জানালামশুনে উনি বললেন, ভালো হয়ে যাবে, তার কারণ কুকুর, বিড়াল অসুস্থ হলে প্রকৃতিগত ভাবেই নাকি কিছু উপায় অবলম্বন করে এবং সুস্থ হয়ে ওঠেঘাস ছিঁড়ে খাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই বমি করলো ভাবলাম বোধ হয় ভালো হয়ে উঠছেসেদিন রাতটা বেশ নিশ্চিন্তেই ঘমোলাম
কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম একদম নেতিয়ে পড়েছে, চিবুকটা থরথর করে কাঁপছে।  অবস্থা বেগতিক দেখে বাড়ি থেকে এক বাটি দুধ হালকা গরম করে নিয়ে গেল. দুধের বাটি দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিল।  তা সত্ত্বেও জোর করে মুখের ভিতর হাত ঢুকিয়ে কয়েক চামচ দুধ খাইয়ে দিলামএর কিছুক্ষণের মধ্যে পাড়ার একটি ছোট্ট ভাইকে ডেকে ওকে সঙ্গে নিয়ে কুকুরটির গায়ে একটি কাপড় জড়িয়ে অটোয় চেপে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দিলাম অটোয় যেতে যেতে একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছিল, কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবিনি একটি কুকুরকে মাথায় হাত বোলানো তো দূরের কথা মুখের ভিতর হাত ঢুকিয়ে চামচে করে দুধ খাওয়াবো 
হঠাৎ দেখলাম কুকুরটি অটোর সীটে নড়াচড়া করছে  তখন পাড়াতুতো ভাইটি বললো, দিদি ওর শরীরের অবস্থা খুব খারাপঅটোয়ালা কাকু তাড়াতাড়ি অটো চালাও এর মিনিট দশেকের মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছলামডাক্তার ওকে দেখেই বললেন, কুকুরটি এরকম কাঁপছে কবে থেকে? আমি বললাম, আজ সকাল থেকেই এরকম দেখছি সঙ্গে যোগ করলাম, না গত চারদিন ধরে জল ছাড়া কিছু খায়নি আমার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারবাবু ওর গায়ে একটি ইনজেকশন দিয়ে দিলো  
ঘর থেকে ডাক্তারবাবু বললেন, আপনার বাড়ির কেউ না খেলে আপনি কি পারতেন চারদিন শুধু শুধু বাড়িতে এভাবে তাকে ফেলে রাখতে? নিরুত্তর আমি সত্যি এর কোনো উত্তরই যে নেই আমার কাছেএর মধ্যে হঠাৎ চোখ গেল কুকুরটির দিকেওর জিভটা কমন বেঁকে যাচ্ছিল আর মুখ দিয়ে বীভৎস একটি আওয়াজ হচ্ছিলো এর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সব শেষফেরার পথে ডাক্তারবাবুকে ইনজেকশনের টাকা দিতে গেলে উনি টাকা নিতে অস্বীকার করেন এবং বলেন, এরপর চোখের সামনে কাউকে অসুস্থ দেখলে দেরি কোরো না

Comments

Popular posts from this blog

ICMR New Recruitment Notice In 2025

Canara Bank Specialist Officer Recruitment 2025

Amazon Free Machine Learning (ML) Course For Students