অমল আছে
অমল আছে
অপর্ণা
দাস
তারিখ
:১৭.৬.২০১৮
একে তো
জৈষ্ঠ্য মাস,
মাথার ওপর
আগুন। এদিকে আবার
অফিস যাবার
তারায় ব্যাগে
জলের বোতলটা
নিতে আজ একদম ভুলে
গেছি। মেট্রো
স্টেশনে ঢোকার
মুখে নিতাইকাকুর
মুদি স্টোর্স
থেকে একটা
৫০০ মিলিগ্রাম
জলের বোতল
কিনে সবে
জল খাচ্ছি
এমন সময়
হাত ঘড়ির
দিকে চোখ
গেল। হাত
ঘড়িতে চোখ
পড়তেই দেখলাম
৯টা ১০
মিনিট। কোনো
রকমে এক
ঢোক জল
খেয়ে বোতলের
মুখটা বন্ধ
করে ব্যাগে
ঢোকালাম। কলকাতার
একটি মাল্টি
ন্যাশনাল কোম্পানীতে
কনটেন্ট রাইটারের চাকরি
করি। ঝড়
বৃষ্টি যাই
হোক ডট
সাড়ে ৯টা থেকে
৯টা ৩৫
মিনিটের মধ্যে
অফিসে ঢুকতে
হবে। তিনদিন
পর পর
এক মিনিটও
দেরি করলে
অতি নিষ্ঠুরের
মতো একদিনের
স্যালারী কেটে
নেবে। এসব
হাজার উত্পটাং
চিন্তারা যখন মাথার মধ্যে
সাঁই সাঁই
করে ঘুরছে ঠিক এমন সময়
চোখে পড়লো
কবি নজরুল
মেট্রো স্টেশনে
মেট্রো ঢুকছে। দেরি
হলেও স্টেশনে
মেট্রো ঢুকতে
দেখে একটুও
খুশি হয়নি,
তার একটাই কারণ
মেট্রোটা
এসি ছিল
না। যাকগে
আর কি
করা যাবে।
প্লাটফর্মে
মেট্রো দাঁড়াতেই
উঠে পড়লাম.মেট্রোয়
উঠেই সিটের
দিকে চোখ
বললাম যদি
কোনো সিট্
খালি থাকে। না সত্যিই
আজ দিনটা
বড্ড খারাপ।
একটাও সিট্
আর অবশিষ্ট
নেই। একি ভদ্র
মহিলা সিট্
ছেড়ে উঠেই
সামনের ওই
ছোট্ট ছেলেটাকে
বকছে কেন?
বোধ হয় পরের
স্টেশনে নামবেন
উনি। না
উনি তো
সেইক্ষণ থেকে ওখানেই
দাঁড়িয়ে রয়েছেন
আর সমানে
সামনের বাচ্চাটাকে
বকাবকি করছেন। নিগ্ঘাট
কোনও দুস্টুমি করেছে। দেখলাম
আশেপাশে উপস্থিত
অনেকেই সিটে
বসার জন্য
বাচ্চাটিকে খুব
বোজাচ্ছেন. কিন্তু
ওর কানে
বোধ হয়
এসবের কিছুই
পৌঁছোচ্ছিলো না,
ও এক
দৃষ্টিতে তাকিয়ে
রয়েছে মেট্রোর
জানলার দিকে।
খুব বেশি
হলে বাচ্চাটির
বয়স আড়াই
কি তিন
হবে। এ
বছর ই
বোধ হয়
প্রি-প্রাইমারিতে
ভর্তি হয়েছে.
স্কুল আইডি
কার্ডটা উল্টে
ছিল তাই
দেখতে পেলাম
না বাচ্চাটি
কোন স্কুলে
ভর্তি হয়েছে। একটু সাহস
করে ভদ্র
মহিলাকে জিজ্ঞেস
করেই ফেললাম,
ম্যাম ওর
কি হয়েছে,
আর সিট্
ছেড়েই বা
উঠে পড়লেন
কেন? আপনি কোন
স্টেশন নামবেন? ভদ্রমহিলা বেশ রাগত গলায়
বললেন, নেতাজি ভবন। কেন
বলুন তো? আমি বললাম,
না তাহলে তো এখনও
তো ১৫ মিনিট বাকি।
এবার ভদ্র
মহিলা একটু
সহজ হয়ে
বললেন, কি
করবো বলুন
এ রোজকার
ঘটনা। ওর
জন্য রোজ
আমাকে এভাবেই
দাঁড়িয়ে যেতে
হয়। আমি পাল্টা
প্রশ্ন করলাম,
লোহার শক্ত
সিটে বসতে
একটুও ভালো
লাগে না? আমার
কথা শুনে
ভদ্র মহিলা
মুচকি হেসে
বললেন, ওর
দিকে একবার তাকিয়ে
দেখুন। দেখলাম,
বাচ্চাটি এক
দৃষ্টিতে কাচের
জানালার দিকে
তাকিয়ে রয়েছে। পাশ থেকে
ভদ্র মহিলা
বললেন, ওর
গাছপালা, পাখি,
আকাশ দেখতে
ভালো লাগে
তাই ও
রোজ এই একই
কান্ড করে। তখন আমি
বললাম, ও
তো এক্কেবারে
পুচকে। আপনার সিটের
পাশে জানলার
দিকে মুখ
ঘুরিয়ে একটু
দাঁড়াতে দিলেই
তো হয়।
তাহলে ওর
আকাশ দেখাও
হলো আর
আপনার সিট্ও পাওয়া
হলো। ভদ্র
মহিলা আমার
কথা শুনে
বললেন, সে
তো আপনি
বুঝলেন কিন্তু
সবাই তো
এমনটা আর
বোঝে না। ওর কেডসের
ধুলো একবার
একজনের গায়ে লেগেছিলো।
সে তো
রীতিমতো রেগে গিয়ে
আমার দুধের
শিশুর গালে
চড় মারবে
বলে হাতও
তুলেছিল। ভদ্র
মহিলার সঙ্গে কথা
চলাকালীন বার
বার আমার
চোখ চলে
যাচ্ছিলো ওই
বাচ্চাটির দিকে
আর মনে
হচ্ছিলো, শুধুমাত্র সিটে বসার জন্য
আমাদের মত তথাকথিত শিক্ষিত,
ভদ্র, রুচিশীল মানুষও যখন কারও
সঙ্গে বাক
বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ি তখন এই
পুঁচকে ছেলেটা
সে সবের
থেকে বহু
যোজন দূরে। ওর চোখ
তখন দূর
আকাশের পাখি
আর আম
গাছের পাতার
দিকে। যেখানে ওর
চোখ শুধু
খুঁজে বেড়ায়
নীল আকাশের
বুকে উড়ন্ত
পাখির বাসা,
আমগাছের পাতায়
পর্যন্ত রোডের
ছটা, আরও কত
কিছু। ওকে
দেখে তখন
আমার ছোটবেলার
কথা মনে
পরে যাচ্ছিল।
আর চোখে
ভাসছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
লেখা "ডাকঘর"
নাটকের অমলের কথা। যে
অমলের
চোখ দুটি
ঠিক এমনই ছিল,
নবীন স্বপ্ন
মাখা চোখ। যে স্বপ্নের
ছিল না নির্দিষ্ট
কোনো সীমা।
স্বপ্ন ছিল পৃথিবীকে
চোখ দু'চোখ ভরে
দেখার , তার
আস্বাদ গ্রহণ
করার। কঠিন
ব্যাধিতে রবি ঠাকুরের "ডাকঘর" নাটকের মুখ্য চরিত্র অমলের অকাল মৃত্যু
হয়েছিল ঠিকই কিন্তু বাস্তবিক জীবনে আজও অমল আছে, অমল থাকবে।
Comments