বারো আনা



বারো আনা
অপর্ণা দাস
তারিখ : ৩০..২০১৮

অটো থেকে দেখলাম রাস্তার বাতিস্তম্ভগুলো এক এক করে জ্বলে উঠছেবাইরের চারপাশটা ভালো করে চোখ বোলাতেই দেখলাম বেলা গড়িয়েছেঅটোর ভাড়া মিটিয়ে যখন ঢালাই রাস্তা ধরে বাড়ির পথে চলেছি, কানে এলো শঙ্খ, ঘন্টা, উলুর ধ্বনি বাড়িতে বাড়িতে সন্ধ্যা আরতি শুরু হয়েছে তাড়াতাড়ি পা চালালাম, আজই তো ভদ্রলোকের আসার কথা কম্পিউটার সারানোর জন্যহ্যাঁ সেদিন ফোনে এমনটাই তো কথা হয়েছিল আমার বাড়ি পাড়ার এক্কেবারে শেষ প্রান্তে, অটো থেকে প্রায় দশ মিনিট হাঁটতে হয়হাঁটতে হাঁটতে যত পাড়ার ভিতর যেতে লাগলাম ততই শঙ্খ, ঘন্টার আওয়াজ কমতে শুরু করলো, বদলে কানে এলো টিভি সিরিয়ালের পরিচিত কচ কচানি  হঠাৎ চোখে পড়লো,  পাড়ার এক ঠাকুমা প্লাস্টিক জলের বোতল বগলে নিয়ে কলতলার দিকে যাচ্ছেপিছন থেকে ডাক দিলাম, ঠাম্মা একটু দাড়াও না ঠাম্মা পিছন ফিরে আমায় বললো, নাতনি, তা এই সবে আফিস থেকে ফিরছো বুঝি? মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁবয়স আর অভাব দুইয়ের ভারে ঠাম্মার শরীর দিন দিন কেমন ক্ষয়াটে হয়ে যাচ্ছেঠাম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি তো চোখে ভালো দেখতে পাও না, তা একটু বেলা থাকতে জল ভরে আনতে পারো না আলো আঁধারি পথে যেতে যেতে দেখলাম ঠাম্মার চোখ দুটো চিকচিক করে উঠেছেতাড়াতাড়ি মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো, সারাদিন খেটেখুটে এসে আর শরীর দেয় না নাতনিকাজে থেকে ফিরেই চান সেরে ঠাকুরকে খেতে দিয়ে নিজের পেটের জোগাড়টা কোনো রকমে করে গা'টা একবার এলিয়ে দিলেই হলো, আর কোনো হুঁশ থাকে না তখন স্বয়ং যম এলেও বোধ হয় সাড়া না পেয়ে ফিরে যাবেনএই বলে ঠাম্মা বাচ্চাদের মতো খিলখিল করে হেসে উঠলোঠিক তখনই জিজ্ঞেস করলাম, ঠাম্মা তুমি আমায় বলোনি তো ঋতুর এত শরীর খারাপ? মাথায় হাত দিয়ে কি যেন একটা ভাবতে ভাবতে বললো, না মানি আমি তো তোমায় বলেছিলুমআমি বললাম, না বিষয়ে তুমি আমায় কিছুই লোনি টানা পনেরো বছর ধরে ঠাম্মা আমার স্কুল ফ্রেন্ড ঋতুদের বাড়ি কাজ করছে সেই সূত্রে ঠাম্মার সঙ্গে দেখা হলেই ঋতুদের বাড়ির খুঁটিনাটি সব গল্পই ঠাম্মা আমার শোনায় ঋতু আমার পাশের পাড়াতেই থাকে আগেরদিন সকালে বাস স্টপে ঋতুর বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তখনই কাকুর থেকে জানতে পারি ঋতুর গলায় মারাত্মক ক্ষত হয়েছিল সেই ক্ষত সারাতে কলকাতা, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই হয়ে মাস দুয়েক হলো সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরেছে শুনলাম এর জন্য ওদের অনেক ধারদেনা হয়েছে তাই তো কলকাতায় ফিরেই ঋতু দুর্বল শরীর নিয়ে কল সেন্টারের চাকরিতে যোগ দিয়েছে এর মধ্যে খেয়াল হলো কলতলা আর মাত্র ২০-৩০ মিটার বাকি আমি বললাম, আচ্ছা ঠাম্মা তুমি তো পঞ্চায়েত থেকে বার্ধক্য ভাতা পাও? উত্তরে ঠাম্মা বললো, নাতনি তা পাই কিন্তু বাড়িতে বসে খেলে সব পয়সা যে 'দিনেই ফুরিয়ে যাবে , একটু জমাতে হবে তো না হলে দু'দিন ছাড়া ব্যামো হলে ডাক্তার দেখাবো কোত্থেকে? মাথা নেড়ে বললাম, একদিকে তুমি ঠিকই বলেছ সঙ্গে যোগ করলাম, ঠাম্মা তোমার দুই ছেলে কি একেবারেই  দেখে না তোমায়? একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠাম্মা বললো, তোমার দাদু বেঁচে থাকতে ওদের আশা করিনি আর এই শেষ বয়সে...কথাগুলো বলতে বলতে ঠাম্মা খুব আবেগতাড়িত হয়ে পড়লো কিছুক্ষনের জন্য মনে হলো, প্রচন্ড জোরে বৃষ্টি নামবে ঠাম্মা কোনোক্রমে নিজেকে সামলে বললো, জানো নাতনি একবার তোমার দাদুর বিড়ির কৌটো থেকে বারো আনা পয়সা পরে গেছিলো, আর আমি সেটা তোমার দাদুকে না জানিয়ে কুড়িয়ে নিয়েছিলুমপরে তোমার দাদু কিভাবে সেটা জানতে পেরে আমায় জুতো দিয়ে খুব মেরেছিলোসেই থেকে আমার শিক্ষা হয়ে গিয়েছে বেঁচে থাকতে কোনোদিন কারও কাছে হাত পাতবো না লক্ষ্য করলাম, কথাগুলো বলতে বলতে ঠাম্মার চিবুক দুটো শক্ত হয়ে উঠলোদেখলাম এর মধ্যে কলতলায় এসে পড়েছি কলতলায় তখন বেশ কয়েকজন জল ভরছিল ওদের দেখে ঠাম্মাকেও আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না আসছি বলে বাড়ির দিকে পা চালালাম সেদিন রাতে কেন জানিনা দু'চোখের পাতা এক করতে পারছিলাম না মনে হচ্ছিল ঠাম্মা আজ পর্যন্ত কখনো স্বামী, ছেলে-মেয়ে, বৌমা কাউকে নিয়েই কোনো কটু মন্তব্য করেনি আজই বোধ হয় মুখ ফস্কে. মাত্র বারো আনা পয়সার জন্য নিজের স্ত্রীকে কেউ এভাবে জুতো দিয়ে মারতে পারে যাই হোক, এই সবকিছু ছাপিয়ে সত্তোরোদ্ধ এক বৃদ্ধার একলা চলার সাহস আত্মসম্মান বোধকে কুর্নিশ না জানিয়ে পারলাম না। ঠাম্মা নিজের খেয়াল রেখো






Comments

Popular posts from this blog

Dreams unlimited

Real relative , who helps in a bad time

Love everyone, everything